ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর
To read in English, Click Here
সাদা পাথর সিলেটের একটি নতুন পর্যটন এলাকা। চোখ যায় যদ্দুর স্তরে স্তরে সাদা পাথর-বিছানো খোলা প্রান্তর। পাহাড়ি ঢলে মেঘালয় থেকে গড়িয়ে নামা এসব সাদা পাথর এখানে তৈরি করেছে এক অদ্ভুত সুন্দর ভূপ্রকৃতি। সাদা পাথরের প্রাচুর্য থেকে তারপর এলাকাটারই নাম হয়ে গেছে সাদা পাথর। দু’দিকে ঢেউ-খেলানো পর্বতপ্রাচীর। মাঝখানে মেঘালয় পাহাড় থেকে লাফিয়ে-পড়া স্ফটিকস্বচ্ছ জলের তীব্র স্রোত বইছে কুলকুল শব্দে চারদিক মুখর করে। সেই জলে নীল আকাশ আর সবুজ পাহাড়ের ঘন ছায়া পড়েছে।

সাদা পাথর এলাকার ঠাঁই সিলেটের উত্তর সীমান্তে, কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে। সাদা পাথরে ছাওয়া রোদ-ঝলসানো বিস্তীর্ণ প্রান্তর ছাড়াও প্রতিদিন পাহাড়ি নদী, ঔপনিবেশিক রোপওয়ে, পাথরের খনি এবং সবুজ পাহাড়ের নয়ন জুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে হাজার হাজার পর্যটক ছুটে যান ভোলাগঞ্জে। ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি হলো বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারি।
বিষয়সূচি
সাদা পাথরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
সাদা পাথরের অবস্থান ধলাই নদীর উৎসমুখে। নদীর তল এখানে সমান্তরাল নয়। ওপরতলার সিঁড়ি যেমন ঢালু হয়ে নেমে আসে, অনেকটা তেমনি। এরই ফলে তৈরি হয়েছে প্রচণ্ড স্রোত আর নির্বিরাম কলধ্বনি। তাছাড়া নদীর তলাও পাথর-বিছানো। স্রোতের নিচে ছোট-বড় সাদা-নীল-খয়েরি নানারকম পাথর। কোনো কোনো পাথর মানুষ-সমান উঁচু। সেসব পাথরে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে থেকে থেকে লাফিয়ে উঠেছে স্রোতোধারা। অনেকক্ষণ জলের এ কলগুঞ্জন শুনলে কেমন যেন নেশা ধরে যায়।
দু’দিকে সবুজ বনে ছাওয়া উঁচু পাহাড়। সেই পাহাড়ের ওপরে দিনমান ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের ভেলা। নীল আকাশ আর সবুজ পাহাড় ঘন ছায়া ফেলেছে নদীর জলে। মুহূর্তেই মন ভালো করে দেবার মতো আশ্চর্য সুন্দর একটি ছবি।
সিলেটের আরও তিনটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রের সঙ্গে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথরের বেশ মিল রয়েছে। সেগুলো হলো জাফলং, বিছানাকান্দি, পান্থুমাই এবং উৎমা ছড়া। এ চারটি জায়গাই ভারতীের মেঘালয়, খাসিয়া-জৈন্তা এবং চেরাপুঞ্জি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। একইভাবে চারটি স্থানই চারটি পৃথক নদীর উৎসস্থল এবং সবগুলোই পাথরের খনিতে ভরা।

যত দিন যাচ্ছে, সাদা পাথর দেখতে প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে পর্যটকদের। কারণ জায়গাটি একেবারে বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক। কোনো কৃত্রিম স্থাপনা নেই। সাদা সাদা পাথরের এই প্রশস্ত বিছানাটি পরিকল্পনা করে কেউ বিছিয়ে দেয় নি। মানুষের হস্তক্ষেপের চিহ্ন নেই। এ সবই গড়িয়ে নেমেছে উন্মাদ পাহাড়ি ঢলে, মেঘালয় থেকে।

সাদা পাথর ভ্রমণ : হাতে রাখুন বাড়তি সময়
প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের জন্যে একটি সুবিধের ব্যাপার হলো, ওপরে উল্লেখ করা দর্শনীয় স্থানগুলি একে অপরের থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আপনি ইচ্ছে করলে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর দেখার পরই সোজা রওনা হতে পারেন ভোলাগঞ্জের তিন কিলোমিটার পূর্বে উৎমা ছড়ার উদ্দেশে। পাহাড়ের কোলে চমৎকার নির্জন সুন্দর একটি জায়গা উৎমা ছড়া। তারপর সেখান থেকে বিছানাকান্দি। বিছানাকান্দির অদূরে রয়েছে পান্থুমাই নামে একটি দারুণ উচ্ছল ঝর্ণাধারা। জাফলং এরও আরো পূর্বদিকে। দিনের আলো যদি থাকে তখনও, আপনি জাফলংয়ের দিকে ছুটতে পারেন। আর যদি রাত নেমে যায়, তবে সিলেট শহরে ফিরে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন দেখতে যাবেন প্রকৃতিকন্যা জাফলং।

সাদা পাথর কীভাবে যাবেন
সাদা পাথর পর্যটন এলাকার অবস্থান সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে। ভারতের সীমান্তঘেঁষা ভোলাগঞ্জের উত্তরপ্রান্তকে বলা হয় ‘দশ নম্বর’। জায়গাটা সিলেট শহর থেকে উত্তরদিকে ৩৫ কিলোমিটার। বাসে বা অটোরিকশায় যেতে সময় লাগে মোটামুটি এক ঘণ্টা। দেশের সবচেয়ে বড় পাথরখনি এই ভোলাগঞ্জেই। তাই সিলেট-ভোলাগঞ্জ মহাসড়ক হাজার হাজার ট্রাকের চাপে ভীষণ ব্যস্ত একটি সড়ক। কিছুদিন আগেও খুবই খারাপ ছিল রাস্তাটি। কিন্তু এখন গোটা রাস্তাটা আরও চওড়া করে পিচের বদলে পাথর-সিমেন্ট দিয়ে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। লোকাল বাস ছাড়াও নেমেছে দোতলা বিআরটিসি এবং ‘সাদা পাথর পরিবহন’ নামে নতুন দু’টি বাস সার্ভিস। আছে সিএনজি-চালিত অটোরিকশা। সিলেট শহরের আম্বরখানায় সিএনজি-চালিত অটোরিকশার স্টেশন, ‘দশ নম্বর’ পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া ১২০ টাকা। বাস স্টপেজের অবস্থান আম্বরখানা থেকে আনুমানিক দু’শো গজ উত্তরে মজুমদারিতে। মজুমদারি থেকে সাদাপাথর সংলগ্ন জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত বিআরটিসির ভাড়া ৬০ টাকা এবং ট্যুরিস্ট বাস ‘সাদা পাথর পরিবহন’-এর ভাড়া ৭০ টাকা। এছাড়া মজুমদারি থেকে লোকাল বাসে ভোলাগঞ্জ পয়েন্টে নেমে রিকশা বা টমটমে করেও যেতে পারেন ‘দশ নম্বরে’, তবে লোকাল বাসগুলি একেবারে ছোট আর জরাজীর্ণ।

বেশি শীত বা বৃষ্টির মৌসুম হলে মজুমদারি থেকে বিআরটিসির দোতলা বাস কিংবা ট্যুরিস্ট বাস ‘সাদা পাথর পরিবহন’-এ ওঠাই ভালো, অন্যথায় আম্বরখানা থেকে সিএনজি-অটোরিকশা নিতে পারেন। দলবদ্ধ ভ্রমণ হলে ২৯ আসনবিশিষ্ট ট্যুরিস্ট বাস ‘সাদা পাথর পরিবহন’ রিজার্ভ নিতে পারেন। নিচে ‘সাদা পাথর পরিবহন’-এর মুঠোফোন নম্বর দেওয়া হলো:
সিলেট টিকেট: ০১৩১১-৬১২৪৫৫, ০১৩১১-৬১২৪৫৯।
কোম্পানিগঞ্জ টিকেট: ০১৩১১-৬১২৪৫৯।
ভোলাগঞ্জ টিকেট: ০১৩১১-৬১২৪৫৬।
সাদা পাথর টিকেট: ০১৩১১-৬১২৪৫৭।
ভোলাগঞ্জের ‘দশ নম্বর’ থেকে ‘সাদা পাথরে’ যেতে হয় নৌকো করে। ছোট ছোট ইঞ্জিন নৌকো। ‘দশ নম্বর’ ঘাটে দেখবেন সার করে বাঁধা। একেকটি নৌকোয় দশ জন করে যাত্রী ওঠা যায়। তিন ঘণ্টার জন্যে সাদা পাথরে যাওয়া-আসার ভাড়া ৮০০ টাকা।

সাদা পাথর হোটেল-রেস্তোরাঁ
সিলেট শহরের বন্দরবাজারে পাকশি রেস্তোরাঁ ও হোটেল এশিয়া, জিন্দাবাজারে পানসি, পাঁচ ভাই ও ভোজনবাড়ি, চৌহাট্টায় আলপাইন রেস্তোরাঁ এবং আম্বরখানায় হাবিব রেস্টুরেন্ট ও ইষ্টিকুটুম রেস্টুরেন্টে ভালো মানের খাবার পাওয়া যায়। তবে সাশ্রয়ী মূল্য ও রান্নার প্রকারের প্রাচুর্যের জন্যে পাঁচ ভাই সবচেয়ে জনপ্রিয়।
যাবার পথে কোম্পানিগঞ্জ সদরে কিংবা টুকেরবাজারে নেমেও খাবার কাজ সেরে নিতে পারেন। কোম্পানিগঞ্জ সদরে মহাসড়কের পাশেই রয়েছে পানসি বাড়ি রেস্তোরাঁ, যাতে মাছ-মাংস-সবজির প্রায় সব আইটেমই ন্যায্য মূল্যে পাওয়া যায়। অধিকন্তু, পর্যটক দলের জন্যে রয়েছে এর স্পেশাল পার্শেল সার্ভিস। পানসি বাড়ি রেস্তোরাঁয় আগাম অর্ডারের জন্যে ০১৭০৭-৩৯৪০৬০ নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।
এছাড়া টুকেরবাজারে নবীণ হোটেল এবং ভোলাগঞ্জ দশ নম্বর এলাকার নৌকোঘাটে মেঘের বাড়ি হোটেলেও মাঝারি মানের খাবার ব্যবস্থা আছে। তবে টুকেরবাজার ও ভোলাগঞ্জের হোটেলগুলির পরিবেশ ধূলিমলিন, কাজেই সিলেট শহর কিংবা কোম্পানিগঞ্জ সদরকেই খাওয়া-দাওয়ার জন্যে পরিকল্পনায় রাখা সুবিধেজনক হবে।

কাছাকাছি অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
সাদা পাথরের কাছাকাছি উৎমা ছড়া, বিছানাকান্দি, পান্থুমাই ও জাফলংয়ের কথা আগে বলেছি। এছাড়াও দেখার মতো অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে সিলেট শহরের আশেপাশেই। শাহজালাল মাজার তো শহরের ভেতরেই, বিশাল মালনিছড়া চা বাগানও শহরের গাঁ ঘেঁষে। তবে যা আপনি একদমই মিস করতে পারেন না সেটা হলো ‘সিলেটের সুন্দরবন’ নামে খ্যাত রাতারগুল জলাবন। প্রচুর বিদেশি পর্যটকও আসেন রাতারগুল দেখতে। এমন আরেকটি খুব জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য হলো লালাখাল, যাকে বলা হয় ‘সিলেটের নীলনদ’। অতঃপর কোম্পানিগঞ্জ-গোয়াইনঘাট ছাড়িয়ে যদি আরও ঘোরার ইচ্ছে আর সময় থাকে আপনার হাতে, তাহলে যেতে পারেন কানাইঘাটের লোভাছড়ায় কিংবা ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে নেমে পড়তে পারেন হাকালুকি হাওরে।
এই সবগুলি পর্যটনকেন্দ্র একসঙ্গে আছে, এখানে।
সাদা পাথরে তোলা একটি ভিডিও
সাদা পাথর এলাকার এটি খুব ছোট একটি ভিডিও, যা আমি আমার একদম সাধারণ নোকিয়া ফোন দিয়ে ধারণ করেছিলাম। কোনোরকম এডিট না করেই সেটা এখানে তুলে দিলাম। দেখুন, কী তীব্র জলস্রোত! আর পানির রং কী অবিশ্বাস্য নীল! এভাবেই সাদা পাথর নিরন্তর মুগ্ধ করে চলেছে সৌন্দর্যপ্রিয় পর্যটকদের।