লালাখাল : সিলেটের নীলনদ

দেখার মতো দারুণ একটি জায়গা সিলেটের লালাখাল। এটি পড়েছে জৈন্তাপুর উপজেলায়, সিলেট শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। ভারতের চেরাপুঞ্জি পাহাড়ের পাদদেশ থেকে বয়ে এসেছে লালাখাল। নামে যদিও ‘খাল’, আদতে এটি একটি নদী, যা চেরাপুঞ্জি পর্বতমালা থেকে উৎসারিত ‘সারি’ নদীর সঙ্গে একই ধারায় মিশেছে।

লালাখালের প্রকৃতি অবিশ্বাস্য সুন্দর! সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা এই নদীর দুই তীর জুড়ে রয়েছে পাহাড়ি বন, লালাখাল প্রাকৃতিক উদ্যান, লালাখাল চা বাগান এবং নানা কিসিমের অজস্র গাছপালা। আপনি যদি একসঙ্গে জাফলং ও লালাখাল ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন তাহলে বুদ্ধিমানের কাজ করবেন, কেননা আপনার জাফলং যাবার পথেই পড়বে লালাখাল। এতে সময় এবং অর্থ দুয়েরই সাশ্রয় হবে।

Lalakhal Shari river, Sylhet
লালাখালের এই স্বচ্ছ সুনীল জল পর্যটকদের টানে।

প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে দেখার জন্যে লালাখাল একটি দারুণ জায়গা। এখানে ঘটেছে ঘন সবুজে ছাওয়া পাহাড়, স্বচ্ছসলিলা নদী, বিস্তৃত চা বাগান এবং নানারকম গাছপালার সুন্দর সন্নিবেশ। তবে লালাখালের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ নদীর পানি। আপনি এই নদীটির একেক অংশে একেক রঙের পানি দেখতে পাবেন। কোথাও দেখবেন গাঢ় নীল জল, কিছুটা এগিয়ে সেটা হালকা নীল, পরের বাঁক পেরিয়ে দেখবেন সেখানকার পানি একেবারে সবুজ, কোথাও সেই পানি আবার স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। চেরাপুঞ্জি আর খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় নেমে আসা স্রোতে নানা ধরণের খনিজের মিশেল এবং বালুকাময় তলদেশের কারণেই নদীটির পানি এমন বহুবর্ণ ধারণ করে।

ঘটনাক্রমে কিংবা পরিকল্পনা করেই, যদি আপনি কোনো পূর্ণিমার রাতে রাতে লালাখাল ঘুরতে যাবার সুযোগ পান, তাহলে জোছনা-ধোয়া এই নদীর রূপ দেখার অভিজ্ঞতা আপনার চিরদিন মনে রাখার মতো একটি স্মৃতি-সম্পদ হয়ে থাকবে। অসংখ্য বাঁকে ভরা লালাখাল নদী। প্রত্যেকটি বাঁকই অপূর্ব। পাহাড়ের দিকে তাকালে আপনার মনে হবে, যেন কোনো কুমোর যত্ন করে নিজহাতে এগুলো গড়েছে। মেঘের ইতস্তত ভাসমান ভেলা এসে পাহাড়ের ওপর ঝুঁকে পড়বে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখবেন কখন যেন সেই ভেলাটি দুই পাহাড়ের মাঝখানে হারিয়ে গেল!

লালাখাল ভ্রমণের সময়

লালাখাল ঘুরে দেখার জন্যে শীতকালই সবচেয়ে ভালো সময়। কেননা নদীর বহুবর্ণ জল শীতেই পরিষ্কার দেখা যায়। তখন ঢেউ থাকে না, পানি থাকে শান্ত ও স্বচ্ছ। অনেক উপর থেকে তাকিয়েও নদীর একেবারে তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। পানি এত পরিষ্কার, যা কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু বর্ষাকালে প্রবল স্রোতের কারণে এই পানি তার রঙ এবং স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া শীতকালে ভ্রমণ করলে আপনি পরিযায়ী পাখিদেরও নাগাল পেয়ে যাবেন।

beautiful Shari river, connected to Jaflong at the top and Lalakhal on the down side.
লালাখাল, সিলেটের নীলনদ বলে খ্যাত।

লালাখাল কীভাবে যাবেন

ট্রেনে ঢাকা থেকে সিলেট

লালাখাল পর্যটন এলাকাটি সিলেট শহরের কাছে। তাই আপনি যদি সিলেটের বাইরে থাকেন, ধরা যাক ঢাকায়, তাহলে আপনাকে আগে সিলেট শহরে পৌঁছুতে হবে। কেননা ঢাকা থেকে সরাসরি লালাখাল যাবার কোনো উপায় নেই। কাজেই রাজধানী ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে চড়ে চলে আসুন সিলেট শহরে। ঢাকা থেকে সিলেট আসে কোন্ কোন্ ট্রেন, এগুলোর সময়সূচি কী, ট্রেনের টিকেটের দাম কত—আপনি এমন সব তথ্যই পাবেন এখানে: “ঢাকা টু সিলেট ট্রেনের সময়সূচি ২০২১।” তবে যদি আপনি চট্টগ্রাম থেকে সিলেট যেতে চান, তাহলে দেখে নিন এই লেখাটি: “চট্টগ্রাম থেকে সিলেট ট্রেনের সময়সূচি ও ভাড়া“।

বাসে ঢাকা থেকে সিলেট

আপনি কি বাসে ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন? ঢাকা থেকে কোন্ কোন্ বাস সিলেটে যায়, কোনটার ভাড়া কত (এসি ও নন-এসি, বাসের কাউন্টারগুলি কোথায় এবং সেগুলোর ফোন নম্বর কী—এমন সব তথ্য দেখে নিন ঢাকা থেকে সিলেট বাসের ভাড়া ও কাউন্টারের ফোন নিবন্ধে।

সিলেট থেকে লালাখাল

সিলেট শহর থেকে লালাখাল যাবার জন্যে, শহরের কেন্দ্রস্থল বন্দর বাজার থেকে একটু পূর্বদিকে এগিয়ে পৌঁছে যান ধোপাদিঘির পারে, যেখানে ওসমানী শিশু পার্ক রয়েছে। এখানে জাফলংগামী একটি লেগুনা, মাইক্রোবাস বা বাসে উঠে বসুন। কন্ট্রাক্টরকে বলে রাখুন যেন আপনাকে সারিঘাটে নামিয়ে দেয়। সারিঘাট জায়গাটা সিলেট ও জাফলংয়ের মাঝামাঝি। সারিঘাটে, লালাখাল যাবার জন্যে আপনি সিএনজি-চালিত অটোরিকশা পাবেন। আপনি যদি নদীপথে লালাখাল যেতে চান তাহলে এখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করুন। ফেরাপথে, লালাখাল থেকে সিলেটগামী বাস ও লেগুনা পাওয়া যায় রাত ৮টা পর্যন্ত।

লালাখালে থাকার ব্যবস্থা

আপনি চাইলে লালাখালের পারে রাত কাটাতে পারেন। উত্তরা রিসোর্ট বা লালাখাল রিসোর্ট নামে একটি রিসোর্ট আছে এখানে। এদের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাও রয়েছে। আরেকটি আবাসন হলো নাজিমগড় রিসোর্ট, এটি লালাখালের কাছে খাদিমনগরে অবস্থিত। যদি আপনি এতে থাকতে চান তাহলে তাদের সাথে আগে থেকেই যোগাযোগ করে যাবেন। নইলে রিসোর্টে রুম খালি পাওয়া অনিশ্চিত হতে পারে।

নাজিমগড় রিসোর্টে তিন ধরণের বাংলো আছে। প্রশস্ত টেরেস, ছোট বাংলো এবং বড় ভিলা আছে বিশ্রাম ও রাত্রাযাপনের জন্যে। এগুলোর ভাড়া আলাদা আলাদা, তবে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাঁচতারা হোটেলের মতোই। এখানে স্পা এবং পুল রয়েছে, আপনি তাতে গা ডুবিয়ে সব ক্লান্তি মুছে ফেলতে পারেন। সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হলো, এর প্রতিটি স্থাপনাই বৃক্ষাচ্ছাদিত টিলার কিনারায়। যে-কোনো ভিলায়, বারান্দায় বা বাংলোতে বসে আপনি হাত বাড়িয়ে গাছপালা স্পর্শ করতে পারেন।

নাজিমগড়ে থাকার খরচ সাধারণ হোটেল-কটেজগুলির চেয়ে কিছুটা বেশি। এক রাত থাকার জন্যে সবচেয়ে সস্তা ‘প্রিমিয়ার’ কক্ষের ভাড়া পড়বে প্রায় ৭,০০০ টাকা, আর প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটের খরচ ১৫,০০০ টাকার মতো। একটি কক্ষে সর্বোচ্চ ৩ জন থাকতে পারবেন। তবে ৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে কোনও ভাড়া লাগে না। দু’জনের নাশতা এই ভাড়ার অন্তর্ভুক্ত।

অন্য বিকল্প হলো, সন্ধ্যার মধ্যে ভ্রমণ শেষ করে সিলেট শহরে ফিরে রাত কাটানো। সিলেট শহরে অনেক কম খরচে ভালো আবাসিক হোটেল পাওয়া যায়। অবশ্য আপনার লালাখাল ভ্রমণ যদি বিছানাকান্দি বা জাফলং ভ্রমণের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাহলে তো ওদিকেই রওনা হবেন। লালাখাল যেহেতু সিলেট শহর থেকে খুব একটা দূরে নয়, তাই সন্ধ্যার পরে নদীতে সাধারণত পর্যটকবাহী নৌকা চলে না। তাই রাত্রিযাপনের ইচ্ছা না থাকলে আপনার লালাখাল ভ্রমণ সন্ধ্যের মধ্যেই শেষ করে নেবেন। নৌবিহার দিয়ে লালাখাল ভ্রমণ শুরু করাই সবচেয়ে ভালো।

blue water of beautiful Lalakhal, called as 'the Nile of Bangla'.
এমন আশ্চর্য সুন্দর পানি কোথায় আছে আর?

নিকটবর্তী দর্শনীয় স্থান

লালাখালের পাশাপাশি সিলেট শহরের আশেপাশে ঘুরে দেখার মতো আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে: হযরত শাহজালাল (রাহ.)-এর মাজার, মালনিছড়া চা বাগান, রাতারগুল জলাবন, জাফলং, বিছানাকান্দি, ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর, লোভাছড়া, পাংথুমাই জলপ্রপাত, উৎমাছড়া, হাকালুকি হাওর ইত্যাদি।

Was this article helpful?
YesNo

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Adblock Detected!

Please help us run the website by disabling your ad blocker.

Refresh Page
Scroll to Top
Scroll to Top